নৈসর্গিক নাগাল্যান্ড
তন্ময় চক্রবর্তী
“ইচ্ছা সম্যক ভ্রমণে কিন্তু পাথেয় নাস্তি‚
পায়ে শিকলি‚ মন উড়ু উড়ু‚ এ কি দৈবের শাস্তি!”
এই লাইন দুটি হয়তো আপামর দশটা-পাঁচটার পাঁচালী পড়া ভ্রমণপিপাসু মনের কথা। কিন্তু পিপাসা আর কতদিনই বা সহ্য করা যায়। আমিও পারিনি। পাহাড়ের নেশা আর অর্থাভাবের পেশা- এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে চার বন্ধুকে নিয়ে পাড়ি দিলাম নাগাদের দেশে। শেক্সপিয়ার সরণির নাগাল্যান্ড হাউস থেকে ইনার লাইন পারমিট নিতে আমরা ভুলিনি।
দিমাপুর Airport
নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা। এর সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর দিমাপুর এ পৌঁছলাম পয়লা মে দুপুর একটায়। সামনে থেকেই গাড়ি ভাড়া করে শুরু হল আমাদের কোহিমার পথে যাত্রা। শেয়ার গাড়ি ও পাওয়া যায়। কিন্তু তা বিমানবন্দর থেকে আট কিলোমিটার দূরে ডিমাপুর স্টেশন থেকে। পূর্ব ভারতের অধিকাংশ স্টেশন এর সাথে রেল মারফত যোগাযোগ আছে দিমাপুর স্টেশনের। দিমাপুর থেকে কোহিমার রাস্তা বড়ই খারাপ। ৭০ কিলোমিটার যেতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। গত তিন বছর ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার অবস্থাই হয়তো বলে দেয় উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রতি সরকার বাহাদুরের অযত্নের কথা। হেলতে দুলতে কোহিমা পৌঁছতে বাজলো বিকেল পাঁচটা। হোটেলে ঢুকেই ব্যাগপত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম কোহিমা শহর দেখতে। খুব সাজানো-গোছানো শহর না হলেও মানুষগুলো বেশ পরিপাটি। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে এদের পোশাকের রং শহরটাকে যেন আরও রঙিন করে তোলে। শহরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড ব্যাপ্টিস্ট চার্চ- এমন সুন্দর চার্চ আমি আগে কখনো দেখিনি। বলাই বাহুল্য নাগাল্যান্ড খ্রীষ্ট-ধর্মী শান্তিপ্রিয় মানুষদের ঘর। আর শহরটাকে ভালো লাগার অন্যতম কারণ পর্যটকদের হট্টগোলের অভাব। বেশ অবাক করা ঘটনাটি ঘটলো সন্ধ্যে ছ'টা বাজতে না বাজতেই।সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হলো এমনকি রেস্টুরেন্টও। বুঝলাম এরা পোকা-ব্যাঙ-সাপ এর মাংস যতই খেয়ে থাকুক না কেন‚ পূর্ব প্রান্তের এই রাজ্যটি দিনের আলোকেই ভালোবাসে বেশি। হয়তো 'Game of Thrones' এর ভাষায় তাদের বিশ্বাস 'The Night is long and full of Terror'।
বসন্ত থেকে গেছে
পরদিন সকালে যাত্রা শুরু হলো প্রকৃত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সবুজ গালিচায় মোড়া dzukou ভ্যালি। কোহিমা গ্রাম থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে ভিস্বেমা গ্রাম। সেখান থেকেই এই ট্রেকের শুরু। যদিও গাড়ি আরও সাত কিলোমিটার এগিয়ে দিতে পারতো আমাদের তবুও আমরা ৭ ঘণ্টা ট্রেকের পথকেই বেছে নিলাম তিন ঘন্টার জায়গায়।
বলে রাখা ভালো এই ট্রেকের আরও দুটি রুট আছে,
প্রথমটি জাখামা গ্রাম থেকে যা কঠিনতর আর দূরত্ব কোহিমা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার ।
অপরটি খনমা গ্রাম থেকে যা পৌঁছে ওয়েস্টার্ন Dzukou তে- যেখানে শীতকালে বরফ পড়ে।
যাই হোক‚ সঙ্গী কয়েকজন বন্ধু র প্রথম ট্রেক হবার কারণে সহজতর ভিশ্বেমা গ্রাম কেই বেছে নিলাম শুরুর সময় ।পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট এই গ্রাম। কিছুক্ষণ পর থেকেই আমরা হাঁটতে থাকলাম দীর্ঘদেহী পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। বসন্তের ছোঁয়া তখনও কাটেনি এদেশে। সবুজ গাছের ছায়ার মধ্যে দিয়ে লাল পাতার কার্পেট বিছানো রাস্তায় হাঁটার সময় মনে হল পিঠের রুকস্যাকটার ভার অনেকটাই কমে গেছে। সবুজে মোড়া পাহাড় গুলোকে দেখতে দেখতে তিন ঘন্টা পর যখন শেষ মোটরেবেল পয়েন্টে পৌঁছলাম তখন আমি সেখানে একা। বুঝলাম বন্ধুরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছ। সাথে যে জলটুকু ছিল‚তাও শেষ। জলের কোন উৎস ও চোখে পড়ে না। এ অবস্থায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর একজন সহযাত্রী বন্ধু শ্রান্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। বাকি তিনজন আরো পিছনে।
সবুজ এর গালিচা!
এক পরিত্যক্ত বোতলে কিছুটা জল পেয়ে ঢেলে দিলাম গলায়‚আর কিছুটা রেখে দিলাম পিছনে থাকা বন্ধুদের জন্য। শুরু হলো পরবর্তী কঠিন খাড়াই এর এক ঘন্টার পথ। ভারতের এই অংশে বৃষ্টির পরিমাণ প্রচুর‚ তাই মসে ঢাকা পাথরগুলো পা গুলোর কঠিন পরীক্ষা নিলে ও রডোডেনড্রন এর হোলি খেলা আমাদের ক্লান্ত হতে দিল না। এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় নিয়ে যখন উত্তরণের পথে যাত্রা শেষ হলো প্রথম চোখে পড়ল dzukou ভ্যালির অপার্থিব সৌন্দর্য আর কানে নাকে লাগলো হিমশীতল হাওয়া। সেখান থেকে আমাদের ক্যাম্প আরো দু ঘন্টার রাস্তা। তখনই বিকেল প্রায় শেষ দশায়। দুজনে মিলে ঠিক করলাম পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম আর মেঘ রোদের খেলা দেখতে দেখতে বাকি বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করা যেতেই পারে। যেমন কথা তেমন কাজ। Coldplay ব্যান্ডের গানের সাথে পরিবেশের গন্ধ নিলাম প্রাণভরে। বাকি বন্ধুরা যখন এসে পৌঁছলো তখন সন্ধে নেমে গেছে। সামনের দু’ঘণ্টার অন্ধকার পথের ভরসা পাঁচজনের পাঁচটি টর্চ। ছোট্ট ছোট্ট বাঁশগাছের জঙ্গলে হাওয়ার শিরশিরানি আওয়াজ আর গান শুনতে শুনতে শেষ হলো আমাদের নাইট ট্রেক।
ফুলের বাহার
নেটওয়ার্ক বিহীন মোবাইলের সেদিন শুধু একটাই কাজ ‘Khachak'। দুজন নাগা বন্ধুর কাছ থেকে ভ্যালি ঘোরার রহস্য জেনে নিয়ে প্রাতরাশ সেরে একাই পাড়ি দিলাম নিচের দিকে। এই রোদ—এই মেঘ-এই বৃষ্টি। লোকে বলে-মেয়েদের মন বোঝা দুরুহ কাজ আর এখানে প্রকৃতি তা শুনে হাসে। হাসে ৷ র্বাশগাছের জঙ্গলের মধ্যে হলুদ রঙের জংলী ফুলগুলো আর শুকনো গাছের গুঁড়িগুলো জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের প্রদর্শনী চালাচ্ছে সেখানে । রঙ বেরঙের পাখি ও পোকার ডাক, ব্যাঙের শোরগোল আর কখনো কখনো ঝোপের মধ্যে পাহাড়ি নাগের শিরশিরানী শুনে মনে হয়- মানবকণ্ঠ বড়ই কর্কশ । একদম ভ্যালির মাঝখানে দাঁড়িয়ে যখন রোদের তেজ-এ গরমই লাগছে-তখনই দূর থেকে কালো মেঘের আবির্ভাব ৷ সাথে সাথে মোবাইলটাকে ট্রাইপড এ রেখে নিলাম একটা timelapse ভিডিও।কয়েক মিনিটের মধ্যে ঝমঝমিয়ে নেমে এল বৃষ্টি, দৌড়ে গিয়ে পৌছলাম সেই সাদা ক্রস-এর নিচে । ঐ দিগন্তবিস্তৃত ভ্যালির মাঝে একা বসে একটাই কথা মনে হয়-“পাহাড় কখনো খালি হাতে ফেরায় না” ।
মেঘের খেলা
বৃষ্টি কিছু কমলে ধীরে ধীরে ফিরে এলাম টেন্ট-এ ৷ তারপর চুপচাপ বসে সারা বিকেল সঙ্গীদের সাথে গল্প আর তাকিয়ে থাকা ঐ ভ্যালির দিকে । প্রত্যেক মুহূর্তে একই ঊপলব্ধি-এ কি অপরূপ সৃষ্টি-এ কি আশ্চর্য খামখেয়ালিপনা । সকলে মিলে গান-বাজনা‚ বার-বি-কিউ, কবিতাপাঠ আর তুমুল ঝড় বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কেটে গেল সন্ধ্যেটা ।
পরদিন সকালে উঠে যখন ঘরে ফেরার পালা, তখনও মেঘ-রোদের খেলায় আমরা সম্মোহিত ।সারা রাতের বৃষ্টির পর যেন আরও সবুজ পাহাড় গুলো-মেঘেদের যেন বড্ড তারা৷ সূর্যের লুক্যেচুরি দেখতে দেখতে যখন ফিরে আসছি আমরা‚ তখন একটাই গান মনে পরে-
“আবার হবে তো দেখা‚ এ দেখা শেষ দেখা নয় গো”
ইনার লাইন পারমিট
শেক্সপীয়ার সরণির নাগাল্যান্ড হাউস থেকে একটি ফর্ম দেওয়া হয়। সেই ফর্ম এর সাথে পাসপোর্ট- সাইজ ছবি ও একটি আই- ডি কার্ড সহ জমা দিলে ১ সপ্তাহ র মধ্যেই দেওয়া হয় পারমিট।
এছাড়া ও কোহীমা পৌঁছে ও স্থানীয় নাগাল্যান্ড হাউস থেকে পেতে পারেন পারমিট।
সঠিক সময়
dzukou ভ্যালি ঘোরার সময় সারা বছর ই যদিও‚ কিন্তু এই অপার সবুজ ফুটে ওঠে বিশেষ করে বর্ষাকাল এ। যদিও বর্ষাকালে পথ কিছু কঠিন হয়‚ তাও জুন- জুলাই মাস এ কিছুদিন এর জন্য যখন dzukou লিলি ফুল ফুটে ওঠে‚ ওই সময় ই পর্যটকদের ভিড় বেশি হই এই উপত্যকায়।